ডিভোর্স হয়ে যাবার পর ভল্ট থেকে আনা বিশাল গয়না-র বাক্স-টা যখন খালি হয়ে গেল, তখন সেটা একটা অন্য কাজে লাগান হল। যত জরুরি কাগজপত্র ওর ভিতর-এ সযত্ন-এ রাখল পরিচয় সেন। সেই সব সার্টিফিকেট গুলো-ই দেখছিল সে। সমস্ত মার্কশীট, ম্যারেজ ও ডিভোর্স প্রমাণপত্র, চাকরির ডাঁই করা সব শংসাপত্র, আর-ও বিভিন্ন নিদর্শনপত্র। একটা সময় ছিল যখন এগুলো-র প্রত্যেক-টা খুব-ই জরুরি ছিল। হনুমানের লেজ-এর মতন। কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এখন। অর্থহীন।
আজ সে যাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম-এ। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। বাড়িতে দেখাশোনা করার কেউ নেই, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, যা হয় আর কি। আমার এক চিলতে জায়গা হল না? কাগজ-গুলি পোড়াতে পোড়াতে ভাবছিল সে। কোথায় গিয়ে উঠব, কারা সব সঙ্গীসাথী হবে, কে জানে? ওর তো আবার চিরকাল-ই বদ্দিপ্রীতি ছিল, ছোটবেলায় ওর সব বন্ধু-গুলি হয় সেনগুপ্ত, নয় দাশগুপ্ত, সেনশর্মা, এই। পরের দিকে-ও তাই, বেশির ভাগ কলিগ-ই ওর বদ্দি। যদি থাকতে না পারে, ওকে কি আর ফিরত আসার সুযোগ দেবে? বৃদ্ধাশ্রম এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই মরতে যায়, ও যাচ্ছে মরতেই। পরিচয়-এর কেমন যেন নিজে-কে আবার ফ্রেশার মনে হল ! যখন নতুন স্কুল-এ, কলেজ-এ ভর্তি হয়েছিল, বা চাকরি-তে ঢুকেছিল, সদ্য প্রেমে পড়েছিল, বিয়ে করে বাবা হয়েছিল, পরে শ্বশুর, ঠাকুর-দা, দাদু হয়ে সদ্য রিটায়ার করেছিল, ওই সবেমাত্র 'ফ্রেশার' কথা-টা জুড়েছিল, আজ-ও পরিচয় ফ্রেশার, ওই বৃদ্ধাশ্রম-এ।
ছ' মাস পর ওর ছেলে মেয়ে, বৌ-মা, জামাই, নাতি-নাতনি যখন ওকে দেখতে এল, কেউ-ই পরিচয়-কে চিনতে পারল না। সবসময় বিষন্ন থাকা এই লোক-টা হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে, একটা ছোট্ট ছেলের মত, নাতি-নাতনিদের কোলে নিয়ে অন্য দাদু-দের সাথে আলাপ করিয়ে দিল, ল্যাংড়া, ভোলা, ল্যাজ-কাটা, ভোম্বল, কানাই - বাচ্চারা নাম শুনে তো হেসে-ই কুটিপাটি!
বাবা-কে এত খুশি তারা অনেকদিন দেখেনি। বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে তাদের নিজেদের ধারনা-ও পাল্টে গেল। তারা সবাই এসেছিল বাবা-কে ফেরত নিয়ে যেতে। উত্তরে বাবা বললো যে সে খুব ভালো আছে, আনন্দে-ই আছে। ইচ্ছে হলে-ই গিয়ে দেখা করে আসবে। এখানে তার কোনও বিশেষ পরিচয় নেই, সেটা-ই খুব স্বস্তির।
পরিচয় ওদের ঠিক বোঝাতে পারল না যে বাড়িতে থাকলে যেমন অনেক স্নেহ থাকে, তেমন বন্ধন-ও প্রচুর। বাড়িতে ওকে একজন বৃদ্ধ লোক হয়ে-ই থাকতে হবে, হয় দাদু, নয়তো বাবা। চলন বলন আচার ব্যবহার সব-ই মানানসই হতে হবে। নয়তো বিচার, যেমন এখানে হিন্দি সিনেমা দেখে নাচানাচি করলে কেউ ভুরু কুঁচকে তাকাবে না, বাগানে লুকোচুরি খেললে কেউ হাসাহাসি করবে না। নিজে বুড়ো হলে বোঝা যায় কি মিথ্যা এই বাইরের বার্ধক্য।
আবার বার্ধক্য যখন চেপে ব'সে ভিতরের শিশু-কে আঘাত করে তখন হাসিখুশি থাকা সম্ভব হয়না। মুখ কালো করে বসে থাকলে তোমরা বলবে আমি নেগেটিভ। আরে বাবা শরীর-টা যখন কষ্ট পায়, লিভার, কিডনি যখন ড্যামেজ হয় তখন কি করে কেউ হেসে হেসে কথা বলে? যারা এখানে ওয়াকার নিয়ে চলে তাদের হাঁটাহাঁটি-টাই একটা বিশাল কাজ, এ ছাড়া বাথরুম ইত্যাদির বিড়ম্বনা তো আছেই। তৎসত্ত্বেও আমরা ঠিক বুড়ো না, আমরা ফ্রেশার। এগুলো কি করেই বা কাউকে বোঝানো যায়!
সবাই-এর সঙ্গে হৈ হৈ করে সারাদিন কাটিয়ে ওরা যখন বাড়ি ফিরতে যাবে তখন বাবা-র ঘরে গিয়ে দেখল বিছানা-তে একটা ডায়েরি রাখা আছে। প্রথম পাতা-এ তাদের মা-এর ছবি আঁকা। তারপর লেখা : আমি আজ বড় খুশি, বৃদ্ধাশ্রম-কে কি ভেবেছিলাম আমি, যে এইখানে মানুষ মরতে আসে? দেখলাম এখানে-ই মানুষ বাঁচতে আসে, এতদিন বেঁচে ছিলাম এক মিথ্যা পরিচয় নিয়ে, আজ আমি খুব-ই আহ্লাদিত, পরের পাতা-এ গিয়ে দেখে তার চার বন্ধু-র সম্পর্কে কিছু লেখা, তাদের নাম দেখে চমকে ওঠে ওরা; অমিত সাঁপুই (ল্যাংড়া), আলী (ভোলা), পঙ্কজ ঢলঢল (ল্যাজ-কাটা), কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি (ভোম্বল), আর কাঞ্চন বরাট (কানাই)।
ঘুরে দেখে বাবা সামনে দাঁড়িয়ে, ওদের মনে হল ওরা যেন এক নতুন বাবা-কে দেখছে, মেয়ে বলে উঠল, 'বাবা আমরা তো জানতাম-ই না তুমি এত সুন্দর ছবি আঁক' আর ছেলে বলল, 'বাবা আমি-ও অবসর নিয়ে এখানে আসবো' উত্তর-এ পরিচয় বললো, 'ইউ মাস্ট', যাবার আগে ছেলে-মেয়ে-রা বললো, 'তোমাকে এখন ঘনঘন দেখতে আসব' । পরিচয় হেসে বললো, 'থ্যাংক ইউ'