Saturday, 17 July 2021

থ্যাংক ইউ

ডিভোর্স হয়ে যাবার পর ভল্ট থেকে আনা বিশাল গয়না-র বাক্স-টা যখন খালি হয়ে গেল, তখন সেটা একটা অন্য কাজে লাগান হল। যত জরুরি কাগজপত্র ওর ভিতর-এ সযত্ন-এ রাখল পরিচয় সেন। সেই সব সার্টিফিকেট গুলো-ই দেখছিল সে। সমস্ত মার্কশীট, ম্যারেজ ও ডিভোর্স প্রমাণপত্র, চাকরির ডাঁই করা সব শংসাপত্র, আর-ও বিভিন্ন  নিদর্শনপত্র। একটা সময় ছিল যখন এগুলো-র প্রত্যেক-টা খুব-ই জরুরি ছিল। হনুমানের লেজ-এর মতন।  কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এখন। অর্থহীন। 

আজ সে যাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম-এ। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। বাড়িতে দেখাশোনা করার কেউ নেই, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, যা হয় আর কি।  আমার এক চিলতে জায়গা হল না? কাগজ-গুলি পোড়াতে পোড়াতে ভাবছিল সে।  কোথায় গিয়ে উঠব, কারা সব সঙ্গীসাথী হবে, কে জানে? ওর তো আবার চিরকাল-ই বদ্দিপ্রীতি ছিল, ছোটবেলায় ওর সব বন্ধু-গুলি হয় সেনগুপ্ত, নয় দাশগুপ্ত, সেনশর্মা, এই। পরের দিকে-ও তাই, বেশির ভাগ কলিগ-ই ওর বদ্দি। যদি থাকতে না পারে, ওকে কি আর ফিরত আসার সুযোগ দেবে? বৃদ্ধাশ্রম এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই মরতে যায়, ও যাচ্ছে মরতেই। পরিচয়-এর কেমন যেন নিজে-কে আবার ফ্রেশার মনে হল ! যখন নতুন স্কুল-এ, কলেজ-এ ভর্তি হয়েছিল, বা চাকরি-তে ঢুকেছিল, সদ্য প্রেমে পড়েছিল, বিয়ে করে বাবা হয়েছিল, পরে শ্বশুর, ঠাকুর-দা, দাদু হয়ে সদ্য রিটায়ার করেছিল, ওই সবেমাত্র 'ফ্রেশার' কথা-টা জুড়েছিল, আজ-ও পরিচয় ফ্রেশার, ওই বৃদ্ধাশ্রম-এ।  

ছ' মাস পর ওর ছেলে মেয়ে, বৌ-মা, জামাই, নাতি-নাতনি যখন ওকে দেখতে এল, কেউ-ই পরিচয়-কে চিনতে পারল না।  সবসময় বিষন্ন থাকা এই লোক-টা হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে, একটা ছোট্ট ছেলের মত, নাতি-নাতনিদের কোলে নিয়ে অন্য দাদু-দের সাথে আলাপ করিয়ে দিল, ল্যাংড়া, ভোলা, ল্যাজ-কাটা, ভোম্বল, কানাই  - বাচ্চারা নাম শুনে তো হেসে-ই কুটিপাটি! 

বাবা-কে এত খুশি তারা অনেকদিন দেখেনি। বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে তাদের নিজেদের ধারনা-ও পাল্টে গেল। তারা সবাই এসেছিল বাবা-কে ফেরত নিয়ে যেতে। উত্তরে বাবা বললো যে সে খুব ভালো আছে, আনন্দে-ই আছে। ইচ্ছে হলে-ই গিয়ে দেখা করে আসবে। এখানে তার কোনও বিশেষ পরিচয় নেই, সেটা-ই খুব স্বস্তির। 

পরিচয় ওদের ঠিক বোঝাতে পারল না যে বাড়িতে থাকলে যেমন অনেক স্নেহ থাকে, তেমন বন্ধন-ও প্রচুর। বাড়িতে ওকে একজন বৃদ্ধ লোক হয়ে-ই থাকতে হবে, হয় দাদু, নয়তো বাবা। চলন বলন আচার ব্যবহার সব-ই মানানসই হতে হবে। নয়তো বিচার, যেমন এখানে হিন্দি সিনেমা দেখে নাচানাচি করলে কেউ ভুরু কুঁচকে তাকাবে না, বাগানে লুকোচুরি খেললে কেউ হাসাহাসি করবে না। নিজে বুড়ো হলে বোঝা যায় কি মিথ্যা এই বাইরের বার্ধক্য। 

আবার বার্ধক্য যখন চেপে ব'সে ভিতরের শিশু-কে আঘাত করে তখন হাসিখুশি থাকা সম্ভব হয়না। মুখ কালো করে বসে থাকলে তোমরা বলবে আমি নেগেটিভ। আরে বাবা শরীর-টা যখন কষ্ট পায়, লিভার, কিডনি যখন ড্যামেজ হয় তখন কি করে কেউ হেসে হেসে কথা বলে? যারা এখানে ওয়াকার নিয়ে চলে তাদের হাঁটাহাঁটি-টাই একটা বিশাল কাজ, এ ছাড়া বাথরুম ইত্যাদির বিড়ম্বনা তো আছেই। তৎসত্ত্বেও আমরা ঠিক বুড়ো না, আমরা ফ্রেশার। এগুলো কি করেই বা কাউকে বোঝানো যায়!

সবাই-এর সঙ্গে হৈ হৈ করে সারাদিন কাটিয়ে ওরা যখন বাড়ি ফিরতে যাবে তখন বাবা-র ঘরে গিয়ে দেখল বিছানা-তে একটা ডায়েরি রাখা আছে। প্রথম পাতা-এ তাদের মা-এর ছবি আঁকা। তারপর লেখা : আমি আজ বড় খুশি, বৃদ্ধাশ্রম-কে কি ভেবেছিলাম আমি, যে এইখানে মানুষ মরতে আসে? দেখলাম এখানে-ই মানুষ বাঁচতে আসে, এতদিন বেঁচে ছিলাম এক মিথ্যা পরিচয় নিয়ে, আজ আমি খুব-ই আহ্লাদিত, পরের পাতা-এ গিয়ে দেখে তার চার বন্ধু-র সম্পর্কে কিছু লেখা, তাদের নাম দেখে চমকে ওঠে ওরা; অমিত সাঁপুই (ল্যাংড়া), আলী  (ভোলা), পঙ্কজ ঢলঢল (ল্যাজ-কাটা), কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি (ভোম্বল), আর কাঞ্চন বরাট (কানাই)। 

ঘুরে দেখে বাবা সামনে দাঁড়িয়ে, ওদের মনে হল ওরা যেন এক নতুন বাবা-কে দেখছে, মেয়ে বলে উঠল, 'বাবা আমরা তো জানতাম-ই না তুমি এত সুন্দর ছবি আঁক' আর ছেলে বলল, 'বাবা আমি-ও অবসর নিয়ে এখানে আসবো' উত্তর-এ পরিচয় বললো, 'ইউ মাস্ট', যাবার আগে ছেলে-মেয়ে-রা বললো, 'তোমাকে এখন ঘনঘন দেখতে আসব' ।  পরিচয় হেসে বললো, 'থ্যাংক ইউ'

Friday, 2 July 2021

The coffee mug

An award ceremony. A scientist, also the awardee, was talking about the importance of thinking from outside the comfort zone; popularly, it is known as out-of-the-box thinking. He shared many examples which had helped him get to the bottom of the invention for which he was awarded. The discourse, followed by a standing ovation and a high tea, was to become a topic of discussion for a long time to come.

In between, when the scientist went home tired, he was desperately in need of a hot cup of coffee. For nearly an hour, he looked in vain at all the places his programmed mind could think of; finally, he gave up and settled for another mug.

The next morning, when he woke up and went to clean the altar, as it were, he found the mug lying there. He was surprised to discover how, the night before while looking for the mug, his mind did not consider the altar as an option.   

Friday, 25 June 2021

নমস্কার

কেরকম গল্পের মত শোনায়! এই তিনজন বন্ধু, যারা কোনদিন বন্ধু হওয়া ত দূরের কথা, একে অপরের সান্নিধ্যে আসবে সে কথা স্বপ্নেও ভাবেনি ! সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট-এ আলাপ। তিনজনের তিনটি ঘটনা, মর্মান্তিক এবং নৃশংসএকজন অ্যাসিড অ্যাটাক-এর ভিক্টিম, নাম সোহাগি, আরেকজন রেপ ভিক্টিম, নাম সোহিনী, আরেকজনকে চালান করে দেওয়া হচ্ছিল, বেঁচে গেছে, নাম সহেলি।  এদের তিনজনেরই বয়স প্রায় কাছাকাছি, আর তিনজনেই পরিস্থিতির শিকার, কাজেই বন্ধুত্বটা স্পিড-পোস্টে আসা চিঠির মতোই খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।  এদের নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যায়, একটা পুরোপুরি সিনেমা-ও বোধহয় করা যায়, কিন্তু আমি একটা ফ্ল্যাশ-ই লিখছি। আমি লিখছি বললে ভুল বলা হবে, ওরাই লিখছে।  আসুন পড়ি।

সোহাগি লিখছে:                              

ছেলেখেলা

আমি কোন লেখক নই, আমি নিজেই একটা গল্প, তাই শেয়ার করছি। আমার বাড়ি পুরুলিয়া, এক প্রত্যন্ত গ্রাম-এর মেয়ে আমি।  বারো বছর বয়সে আমার মা-বাবা আমাকে বিয়ে দেয়  এক একান্নবর্তী পরিবারের পনের বছরের ছেলের সাথে।  তিনবছর সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, আমাকে পড়াশোনাও করতে দিত আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। শাশুড়ি আমাকে খুবই ভালবাসত, আমার যে এতো ছোট বয়েসে বিয়ে হয়েছে, সেটা তার মোটেও পছন্দ ছিল না, বাড়িতে আমাকে নিয়ে কোন গন্ডগোল হলে, যেমন ঠিক করে কাপড় পরা, কাজ করা, আত্মীয়স্বজন-এর সাথে কথা বলাএসব নিয়ে কোন ভুল হলে উনি এগিয়ে আসতেন আর আমাকে ডিফেন্ড করতেন।  আমার মেজ-শশুরের ছেলে প্রণব-এর আমার ওপর কুনজর পড়ল। আর তারপর থেকেই শুরু হল যত অশান্তি। যা হয় আর কি, ওর মা-বাবা আমাকেই দোষ দিতে আরম্ভ করল। আমার চলন-বলন নিয়ে কটাক্ষ করত।  প্রণবকে কেউ কিছু বলত না। আমার ওকে দেখলেই ভয় করত।  একদিন ছাতে আমি কাপড় মেলতে গিয়ে দেখি প্রণব, ও আমাকে জড়িয়ে ধরল আর আমি প্রাণপণে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সেইদিন আমার শাশুড়ি এসে আমাকে বাঁচালেও, কেউ-ই ঠিক গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাকে। আমি নিচে এসে চিৎকার করতে গিয়ে দেখলাম আমার শ্বশুর, খুড়-শ্বশুর জোরে টিভি চালিয়ে দিয়েছে, যাতে আমার আওয়াজ বাইরে না যায়। ছাত থেকে এক প্রতিবেশী কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় খুড়শাশুড়ি বললো, ও দেবর আর বৌদি রসিকতা করছে।  

ওর বয়স তখন পঁচিশ, শুনেছি ও নাকি বৌ-এর গলা টিপে মেরে ফেলেছিল, কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা কি করে জানি ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খবর ছড়িয়ে যাবার জন্যে ওর আর বিয়ে হচ্ছিল না, জোয়ান ছেলে এসব দোষ তো একটু থাকবেই, তাই ওকে কেউ কিছুই বললো না।  কিন্তু প্রণব একটা হিংস্র জন্তু-এর মত আমাকে বললো,  ‘তোকে আমি দেখে নেব।‘ আমার স্বামী-কে বলাতে ও হেসেই উড়িয়ে দিলো, ওর তখন সাতাশ।

সেদিন-টা ছিল মঙ্গলবার, আমরা সবাই হাট-এ যাই। একদিক-এ ছৌ নাচ হচ্ছে, অন্যদিকে-এ সবাই মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ-ই একটা মুখোশ পড়া ছেলে আমাকে তাক করে অ্যাসিড ছুড়ে পালিয়ে গেলো। আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। কেউ জানতে পারেনি ছেলেটি কে, বাড়ির লোকেরা প্রণব-কে সন্দেহ করলেও কেউ কিছুই বললো না, এমনকি আমার শাশুড়ি-ও না। সেদিন বাড়িতে এসে সবাই দেখেছিল ওকে ঘুমিয়ে থাকতে, তাই ওর ওপর আর কেউ সন্দেহ করেনি, পুলিশ কাউকে সনাক্ত করতে না পেরে, কেস-টা ক্লোস্ড হয়ে যায়।

আজ দেখুন, দশ বছর পরে, আমি উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মিস ইউনিভার্স হয়েছি।  কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? নয়ত আমি আমার মত অ্যাসিড এটাক-এ ক্ষতবিক্ষত মুখ নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারতাম? হতে পারতাম মিস ইউনিভার্স? খেলার ছলে প্রণব নিস্তার পেয়ে গেলো ঠিকিই কেননা তাকে ধরা যায়নি, কিন্তু আমাকেও ধরে রাখা যায়নি।  আমার যুদ্ধ-টা কিন্তু ছেলেখেলা নয়, নমস্কার।

সোহিনী লিখছে :

ছেলেমানুষ

আমি কলকাতা-র মেয়ে হলেও, খুব রক্ষনশীল পরিবার-এর।  এ যুগে দাঁড়িয়েও আমাকে শাড়ি পড়ার জন্য জোর করা হত।  হাত-কাটা ব্লাউজ পড়া নিষেধ, ইত্যাদি প্রভৃতি। আমি একদিন বাবা-কে জিজ্ঞেস করলাম কেন আমাদের জন্য এত বিধি-নিষেধ। উত্তরে উনি বোঝান, বাইরের জগৎ-টা খুবিই খারাপ, মেয়েরা হচ্ছে সম্পদ-এর মত, খুব সাবধানে থাকতে হয়।  ২০২১ এটা! অবিশ্বাস্য!

এত সাবধানে থেকেও আমার নিজের কাকু আমাকে রেপ করে।  আমার বাড়ির ভিতরে, দুপুরবেলা।  সে জঘন্য ঘটনা বর্ণনা করছি না।  বরং আপনারা শুনুন তারপর কি হয়েছিল। আমার বাবা অফিস থেকে এসে যখন আমাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পায়, তখন সে আমার চালচলন কেন ঠিক করা উচিত সে বিষয় জ্ঞান দিতে থাকে।  আর কাকু-র প্রসঙ্গে বলে, 'ও ছেলেমানুষ ওকে ক্ষমা করে দে, বাড়ির কলঙ্ক পাঁচ-কান করিস না, এতে তোরই অমঙ্গল হবে'।  আমি সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। আজ নারী-সংস্থার কাছে না আসলে আমি নিজের পায় নিজে দাঁড়াতেই পারতাম না। সাহসী নারী পুরস্কার-ও পেতাম না, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে এতো কথা-ও বলতে পারতাম না। শুধু তাই না, আজ আমি একজন সাবলম্বী নারী, মাথা উঁচু করে শাড়ির ব্যবসা করছি এবং আমার সাথে আমার মত আরও উনিশজন মেয়ের রোজগারের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। কিন্তু এই পুরস্কার নিতে আমার ভিতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস করুন।  আজ আমার কাকু (কাকু বলতে লজ্জা করলে, বাবা-কে বাবা বলি কি করে বলতে পারেন?) শাস্তি পেয়েছেন  এই নারী-সংস্থার জন্যই।  কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? তবুও আরও উন্নতির প্রয়োজন আছে।  আমার মনে হয়, শাস্তির থেকেও শিক্ষার প্রয়োজন বেশি। আমার মত বাবা-কাকু তো এখনও ঘরে ঘরে রয়েছে, তাই না? নমস্কার

সহেলি লিখছে:

ছেলেধরা

হ্যাঁ, আমার নাম সহেলি।  আমার মা-এর এক গ্রাহক শুনেছি আমায় এই নাম দেয়, সম্ভবতঃ উনিই আমার বাবা। কালীঘাট-এ আমি বেড়ে উঠেছি।  আমরা, যারা নিষিদ্ধ পল্লীর বাচ্চা, তাদের পাচার করা বোধহয় সবচেয়ে সোজা। একদিন পঞ্চা দা  অনেক লজেন্স দিয়ে আমাকে বললো, 'সহেলি, তোকে আর এইখানে থাকতে হবেনা। আমি তোকে একটা বড়লোক পরিবারের কাছে দিয়ে আসবো, ওরা তোর ছবি দেখে তোকে নিতে চেয়েছে। তোর মা-কে বলিস না, তাহলে তোকে যেতে দেবেনা।' আমি তখন সদ্য নয় পা দিয়েছি, বুঝতেই পারিনি যে ডাহা মিথ্যে কথা বলে আমাকে পাচার করার ফন্দি আটছে পঞ্চা-দা।  আরেকটু বড় হলে জানতাম যে জেনেশুনে কেউ আমাদের মত বাচ্চাদের গ্রহণ করেনা, তারা adoption centre এ যায়।


সে যাই হোক, রওনা হলাম, গোলাপি একটা সুন্দর ফ্রক ছিল, সেইটা পরে, গোলাপি ফিতে বেঁধে, একটা নতুন চটি কিনে তো চললাম, মা-কে না বলেই; দুপুরবেলা মা তখন ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আমাকে হাওড়া স্টেশন-এ নিয়ে এলো, আমি ভাবলাম ট্রেন-এ চড়বো, খুব মজা হবে, কিন্তু আমাকে একটা ট্রাক-এর পিছনে উঠতে বললো, আমি লাফিয়ে উঠে পড়লাম। উঠেই আমাকে চানাচুর আর চা দিল।  আমি সেটা খাবার পর ঘুমিয়ে পড়লাম, উঠে দেখি আমি একটা মাঠের মধ্যে, আর একজন গোঁফওয়ালা লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  আমি তাকে বললাম, 'তুমি কি আমার বাবা?' লোকটা হো হো করে হাসল, তাকে হাসতে দেখে আমিও হাসতে লাগলাম।  ওই লোকটার কাছে পরে জানলাম পঞ্চা-দা আমাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে।  আমি দেখে বুঝতে পারলাম লোকটা কারুর জন্য অপেক্ষা করছে আর লোকটা ল্যাংড়া। আর  কিছু চিন্তা ভাবনা না করে আমি ছুট লাগলাম, ওই ছুট আমি কোনোদিন-ও ভুলব না, অন্তত ছ' ঘন্টা ছুটে একটা রাস্তা দেখতে পেলাম। তখন অনেক রাত, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, দূরে দেখলাম এক দম্পতি বাস-এ ওঠার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি ছুটে গিয়ে ওনাদের সব কথা বলি। ওনারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান, পরে জানি ওনারা একটা এনজিও-এর সাথে যুক্ত, আশ্চর্যভাবে ওনারা আমাকে এক রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে যান আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমার নতুন যাত্রা। ওই দম্পতি-র সাথে আজ-ও আমার যোগাযোগ যাতায়াত আছে, ওনারা আমার কাছে মা-বাবার থেকে কোন অংশে কম না।  আজ যে আমি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকতা করে একটা নাম করা আইটি কোম্পানি-তে কাজ করি, এর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওদেরই। পরে আমি আমার মা-র সাথেও দেখা করি, বহু অনুরোধ করি চলে আসার জন্য। মা আসেনি, বলেছে 'তোর জগৎ-এ গিয়ে আমি কোনরকম অসুবিধে করতে চাইনা, আমি আমার জগৎ-এই ঠিক আছি। তুই যদি নিজে কখন-ও বাড়ি কিনিস, তবে আমি যাব। জানলাম পঞ্চা-দা তখন বিরাট নেতা, পঞ্চানন ঢলঢল, সকলের নাগালের বাইরে। আমি চাকরি করছি চার বছর, আজ আমি ফ্ল্যাট কিনেছি, মা-কে নিয়ে যাব এবার। আমি এই গল্প আপনাদের বলছি তার অনেক কারণ আছে।

কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? আজ একদিকে দুর্নীতি যেমন বেড়েছে, তার সাথে সাথে সমাজ-ও এখন অনেক প্রগতিশীল হয়েছে। আমি যেই কোম্পানি-তে কাজ করি, সেখানে আমি ইন্টারভিউ-তে সমস্ত কিছু বলি।  আপনারা জেনে খুশি হবেন, আমার রিলিজিয়ান, এবং আমার বাবা-র নাম-এর জায়গাটা খালি রাখাতে ওরা কোন আপত্তি করেনি। পরিবর্তে আমি আমার মা-এর নাম লিখেছি। এই যে কত সংস্থা, যেগুলো আমাদের মত হতভাগ্য ছেলেমেয়েদের মানুষ করছে, অভয় দিচ্ছে, থাকা-খাবার জায়গা দিচ্ছে, এটা কি কমপৃথিবী-তে যেমন দুষ্টু লোক আছেন, তেমন ভাল লোক-ও আছেন প্রচুর। নমস্কার।

এই হল এ-যুগের তিন কন্যার কাহিনী। আর-ও বহু গল্প রয়েছে জানেন? যেমন এই সেদিন-ই শুনলাম এক অদ্ভুত ঘটনা।  আজকালকার দিন-এ এও সম্ভব। একটি দশ বছরের মেয়ে, তার মা, মাসি, এবং দিদা তাদের কুল-গুরুকে অনুরোধ করে তার সাথে মৈথুন করিয়েছে!মেয়েটা-কে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জোরে টিভি চালিয়ে দিয়েছে, মেয়েটা ভিতরে চিৎকার করছে। এই অন্ধকার কি কোনোদিন-ও কাটবে? মেয়েটা তার বন্ধু-এর মায়ের সাথে থানাতে গিয়ে এফ আই আর করে, তাদের গুরুবাবা তাকে গুড টাচ না করে ব্যাড টাচ করেছে, এই মর্মে। তাই আমরা জানতে পারি। এইসব অভিভাবক-দের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার।

এত গল্প থাকতে আমি এই তিনটে গল্পই বাছলাম কেননা নাম ছাড়াও এদের জীবনের একটা মিল রয়েছে। এদের তিনজনের প্রতিকুলতা তাদের ঘরের থেকেই এসেছে, তাই বুঝি এরা আজ এতো বন্ধু। এরা প্রত্যেকেই চরম নিষ্ঠুরতার শিকার, কিন্তু প্রত্যেকেই একটা সাকসেস স্টোরি। তারা এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর জন্যে তাদের সাফল্যের কাহিনী ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকের কাছে। তারা একটা গ্রুপ করেছে যেখানে এই ধরণের অভাগা মেয়েদের সোশ্যাল মোবিলিটি, এবং মেন্টাল সাপোর্ট দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা কমন জায়গা না হলে এটা হয়ত সত্যি-ই অসম্ভব হত।

তাই এ কথা মানতেই হবে যে বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আজ অনেক পাল্টেছে।  ভাবুন তো, অ্যাসিড এটাক-এর একজন ভিক্টিম-কে সমাজ আজ মিস ইউনিভার্স করছে! এ মনের প্রসারতা না হলে কি সম্ভব, মিস ইউনিভার্স-এর তথাকথিত বয়সের সীমা, রূপ-এর সংজ্ঞাই আজ কতটা পাল্টে গিয়েছে বলুন তো?

বহু মেয়েরা এগিয়ে এসে তাদের গল্প শেয়ার করছে। প্রত্যেকেই বলছে, ঘটনাগুলি যত না বেদনাদায়ক, তার থেকে আরও বেশি কষ্টের হচ্ছে সমাজের কটাক্ষ।  সমস্ত নারীরাই আজ একই ভাষায় কথা বলছে, যে তারা অত্যাচারের শিকার হওয়া সত্ত্বেও সমাজ তাদের কেন স্বীকার করে না? তাই আরো অনেক পথ চলা বাকি আছে। এক ভয়াবহ রিপোর্টে পড়লাম যে ৮০% ধর্ষণ বাড়ির ভিতরে হয়! এবার বুঝি বলবার সময় এসেছে, 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে', ঘরে ঘরে তাই সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। নয়ত অপরাধীরা ছাড়া পাবে, কেউ কেউ আবার সমাজ-এর রক্ষক-ও হয়ে বসবে।

নমস্কার।