Friday, 25 June 2021

নমস্কার

কেরকম গল্পের মত শোনায়! এই তিনজন বন্ধু, যারা কোনদিন বন্ধু হওয়া ত দূরের কথা, একে অপরের সান্নিধ্যে আসবে সে কথা স্বপ্নেও ভাবেনি ! সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট-এ আলাপ। তিনজনের তিনটি ঘটনা, মর্মান্তিক এবং নৃশংসএকজন অ্যাসিড অ্যাটাক-এর ভিক্টিম, নাম সোহাগি, আরেকজন রেপ ভিক্টিম, নাম সোহিনী, আরেকজনকে চালান করে দেওয়া হচ্ছিল, বেঁচে গেছে, নাম সহেলি।  এদের তিনজনেরই বয়স প্রায় কাছাকাছি, আর তিনজনেই পরিস্থিতির শিকার, কাজেই বন্ধুত্বটা স্পিড-পোস্টে আসা চিঠির মতোই খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।  এদের নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যায়, একটা পুরোপুরি সিনেমা-ও বোধহয় করা যায়, কিন্তু আমি একটা ফ্ল্যাশ-ই লিখছি। আমি লিখছি বললে ভুল বলা হবে, ওরাই লিখছে।  আসুন পড়ি।

সোহাগি লিখছে:                              

ছেলেখেলা

আমি কোন লেখক নই, আমি নিজেই একটা গল্প, তাই শেয়ার করছি। আমার বাড়ি পুরুলিয়া, এক প্রত্যন্ত গ্রাম-এর মেয়ে আমি।  বারো বছর বয়সে আমার মা-বাবা আমাকে বিয়ে দেয়  এক একান্নবর্তী পরিবারের পনের বছরের ছেলের সাথে।  তিনবছর সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, আমাকে পড়াশোনাও করতে দিত আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। শাশুড়ি আমাকে খুবই ভালবাসত, আমার যে এতো ছোট বয়েসে বিয়ে হয়েছে, সেটা তার মোটেও পছন্দ ছিল না, বাড়িতে আমাকে নিয়ে কোন গন্ডগোল হলে, যেমন ঠিক করে কাপড় পরা, কাজ করা, আত্মীয়স্বজন-এর সাথে কথা বলাএসব নিয়ে কোন ভুল হলে উনি এগিয়ে আসতেন আর আমাকে ডিফেন্ড করতেন।  আমার মেজ-শশুরের ছেলে প্রণব-এর আমার ওপর কুনজর পড়ল। আর তারপর থেকেই শুরু হল যত অশান্তি। যা হয় আর কি, ওর মা-বাবা আমাকেই দোষ দিতে আরম্ভ করল। আমার চলন-বলন নিয়ে কটাক্ষ করত।  প্রণবকে কেউ কিছু বলত না। আমার ওকে দেখলেই ভয় করত।  একদিন ছাতে আমি কাপড় মেলতে গিয়ে দেখি প্রণব, ও আমাকে জড়িয়ে ধরল আর আমি প্রাণপণে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সেইদিন আমার শাশুড়ি এসে আমাকে বাঁচালেও, কেউ-ই ঠিক গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাকে। আমি নিচে এসে চিৎকার করতে গিয়ে দেখলাম আমার শ্বশুর, খুড়-শ্বশুর জোরে টিভি চালিয়ে দিয়েছে, যাতে আমার আওয়াজ বাইরে না যায়। ছাত থেকে এক প্রতিবেশী কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় খুড়শাশুড়ি বললো, ও দেবর আর বৌদি রসিকতা করছে।  

ওর বয়স তখন পঁচিশ, শুনেছি ও নাকি বৌ-এর গলা টিপে মেরে ফেলেছিল, কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা কি করে জানি ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খবর ছড়িয়ে যাবার জন্যে ওর আর বিয়ে হচ্ছিল না, জোয়ান ছেলে এসব দোষ তো একটু থাকবেই, তাই ওকে কেউ কিছুই বললো না।  কিন্তু প্রণব একটা হিংস্র জন্তু-এর মত আমাকে বললো,  ‘তোকে আমি দেখে নেব।‘ আমার স্বামী-কে বলাতে ও হেসেই উড়িয়ে দিলো, ওর তখন সাতাশ।

সেদিন-টা ছিল মঙ্গলবার, আমরা সবাই হাট-এ যাই। একদিক-এ ছৌ নাচ হচ্ছে, অন্যদিকে-এ সবাই মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ-ই একটা মুখোশ পড়া ছেলে আমাকে তাক করে অ্যাসিড ছুড়ে পালিয়ে গেলো। আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। কেউ জানতে পারেনি ছেলেটি কে, বাড়ির লোকেরা প্রণব-কে সন্দেহ করলেও কেউ কিছুই বললো না, এমনকি আমার শাশুড়ি-ও না। সেদিন বাড়িতে এসে সবাই দেখেছিল ওকে ঘুমিয়ে থাকতে, তাই ওর ওপর আর কেউ সন্দেহ করেনি, পুলিশ কাউকে সনাক্ত করতে না পেরে, কেস-টা ক্লোস্ড হয়ে যায়।

আজ দেখুন, দশ বছর পরে, আমি উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মিস ইউনিভার্স হয়েছি।  কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? নয়ত আমি আমার মত অ্যাসিড এটাক-এ ক্ষতবিক্ষত মুখ নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারতাম? হতে পারতাম মিস ইউনিভার্স? খেলার ছলে প্রণব নিস্তার পেয়ে গেলো ঠিকিই কেননা তাকে ধরা যায়নি, কিন্তু আমাকেও ধরে রাখা যায়নি।  আমার যুদ্ধ-টা কিন্তু ছেলেখেলা নয়, নমস্কার।

সোহিনী লিখছে :

ছেলেমানুষ

আমি কলকাতা-র মেয়ে হলেও, খুব রক্ষনশীল পরিবার-এর।  এ যুগে দাঁড়িয়েও আমাকে শাড়ি পড়ার জন্য জোর করা হত।  হাত-কাটা ব্লাউজ পড়া নিষেধ, ইত্যাদি প্রভৃতি। আমি একদিন বাবা-কে জিজ্ঞেস করলাম কেন আমাদের জন্য এত বিধি-নিষেধ। উত্তরে উনি বোঝান, বাইরের জগৎ-টা খুবিই খারাপ, মেয়েরা হচ্ছে সম্পদ-এর মত, খুব সাবধানে থাকতে হয়।  ২০২১ এটা! অবিশ্বাস্য!

এত সাবধানে থেকেও আমার নিজের কাকু আমাকে রেপ করে।  আমার বাড়ির ভিতরে, দুপুরবেলা।  সে জঘন্য ঘটনা বর্ণনা করছি না।  বরং আপনারা শুনুন তারপর কি হয়েছিল। আমার বাবা অফিস থেকে এসে যখন আমাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পায়, তখন সে আমার চালচলন কেন ঠিক করা উচিত সে বিষয় জ্ঞান দিতে থাকে।  আর কাকু-র প্রসঙ্গে বলে, 'ও ছেলেমানুষ ওকে ক্ষমা করে দে, বাড়ির কলঙ্ক পাঁচ-কান করিস না, এতে তোরই অমঙ্গল হবে'।  আমি সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। আজ নারী-সংস্থার কাছে না আসলে আমি নিজের পায় নিজে দাঁড়াতেই পারতাম না। সাহসী নারী পুরস্কার-ও পেতাম না, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে এতো কথা-ও বলতে পারতাম না। শুধু তাই না, আজ আমি একজন সাবলম্বী নারী, মাথা উঁচু করে শাড়ির ব্যবসা করছি এবং আমার সাথে আমার মত আরও উনিশজন মেয়ের রোজগারের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। কিন্তু এই পুরস্কার নিতে আমার ভিতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস করুন।  আজ আমার কাকু (কাকু বলতে লজ্জা করলে, বাবা-কে বাবা বলি কি করে বলতে পারেন?) শাস্তি পেয়েছেন  এই নারী-সংস্থার জন্যই।  কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? তবুও আরও উন্নতির প্রয়োজন আছে।  আমার মনে হয়, শাস্তির থেকেও শিক্ষার প্রয়োজন বেশি। আমার মত বাবা-কাকু তো এখনও ঘরে ঘরে রয়েছে, তাই না? নমস্কার

সহেলি লিখছে:

ছেলেধরা

হ্যাঁ, আমার নাম সহেলি।  আমার মা-এর এক গ্রাহক শুনেছি আমায় এই নাম দেয়, সম্ভবতঃ উনিই আমার বাবা। কালীঘাট-এ আমি বেড়ে উঠেছি।  আমরা, যারা নিষিদ্ধ পল্লীর বাচ্চা, তাদের পাচার করা বোধহয় সবচেয়ে সোজা। একদিন পঞ্চা দা  অনেক লজেন্স দিয়ে আমাকে বললো, 'সহেলি, তোকে আর এইখানে থাকতে হবেনা। আমি তোকে একটা বড়লোক পরিবারের কাছে দিয়ে আসবো, ওরা তোর ছবি দেখে তোকে নিতে চেয়েছে। তোর মা-কে বলিস না, তাহলে তোকে যেতে দেবেনা।' আমি তখন সদ্য নয় পা দিয়েছি, বুঝতেই পারিনি যে ডাহা মিথ্যে কথা বলে আমাকে পাচার করার ফন্দি আটছে পঞ্চা-দা।  আরেকটু বড় হলে জানতাম যে জেনেশুনে কেউ আমাদের মত বাচ্চাদের গ্রহণ করেনা, তারা adoption centre এ যায়।


সে যাই হোক, রওনা হলাম, গোলাপি একটা সুন্দর ফ্রক ছিল, সেইটা পরে, গোলাপি ফিতে বেঁধে, একটা নতুন চটি কিনে তো চললাম, মা-কে না বলেই; দুপুরবেলা মা তখন ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আমাকে হাওড়া স্টেশন-এ নিয়ে এলো, আমি ভাবলাম ট্রেন-এ চড়বো, খুব মজা হবে, কিন্তু আমাকে একটা ট্রাক-এর পিছনে উঠতে বললো, আমি লাফিয়ে উঠে পড়লাম। উঠেই আমাকে চানাচুর আর চা দিল।  আমি সেটা খাবার পর ঘুমিয়ে পড়লাম, উঠে দেখি আমি একটা মাঠের মধ্যে, আর একজন গোঁফওয়ালা লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  আমি তাকে বললাম, 'তুমি কি আমার বাবা?' লোকটা হো হো করে হাসল, তাকে হাসতে দেখে আমিও হাসতে লাগলাম।  ওই লোকটার কাছে পরে জানলাম পঞ্চা-দা আমাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে।  আমি দেখে বুঝতে পারলাম লোকটা কারুর জন্য অপেক্ষা করছে আর লোকটা ল্যাংড়া। আর  কিছু চিন্তা ভাবনা না করে আমি ছুট লাগলাম, ওই ছুট আমি কোনোদিন-ও ভুলব না, অন্তত ছ' ঘন্টা ছুটে একটা রাস্তা দেখতে পেলাম। তখন অনেক রাত, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, দূরে দেখলাম এক দম্পতি বাস-এ ওঠার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি ছুটে গিয়ে ওনাদের সব কথা বলি। ওনারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান, পরে জানি ওনারা একটা এনজিও-এর সাথে যুক্ত, আশ্চর্যভাবে ওনারা আমাকে এক রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে যান আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমার নতুন যাত্রা। ওই দম্পতি-র সাথে আজ-ও আমার যোগাযোগ যাতায়াত আছে, ওনারা আমার কাছে মা-বাবার থেকে কোন অংশে কম না।  আজ যে আমি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকতা করে একটা নাম করা আইটি কোম্পানি-তে কাজ করি, এর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওদেরই। পরে আমি আমার মা-র সাথেও দেখা করি, বহু অনুরোধ করি চলে আসার জন্য। মা আসেনি, বলেছে 'তোর জগৎ-এ গিয়ে আমি কোনরকম অসুবিধে করতে চাইনা, আমি আমার জগৎ-এই ঠিক আছি। তুই যদি নিজে কখন-ও বাড়ি কিনিস, তবে আমি যাব। জানলাম পঞ্চা-দা তখন বিরাট নেতা, পঞ্চানন ঢলঢল, সকলের নাগালের বাইরে। আমি চাকরি করছি চার বছর, আজ আমি ফ্ল্যাট কিনেছি, মা-কে নিয়ে যাব এবার। আমি এই গল্প আপনাদের বলছি তার অনেক কারণ আছে।

কে বলেছে পৃথিবীর উন্নতি হয়নি? আজ একদিকে দুর্নীতি যেমন বেড়েছে, তার সাথে সাথে সমাজ-ও এখন অনেক প্রগতিশীল হয়েছে। আমি যেই কোম্পানি-তে কাজ করি, সেখানে আমি ইন্টারভিউ-তে সমস্ত কিছু বলি।  আপনারা জেনে খুশি হবেন, আমার রিলিজিয়ান, এবং আমার বাবা-র নাম-এর জায়গাটা খালি রাখাতে ওরা কোন আপত্তি করেনি। পরিবর্তে আমি আমার মা-এর নাম লিখেছি। এই যে কত সংস্থা, যেগুলো আমাদের মত হতভাগ্য ছেলেমেয়েদের মানুষ করছে, অভয় দিচ্ছে, থাকা-খাবার জায়গা দিচ্ছে, এটা কি কমপৃথিবী-তে যেমন দুষ্টু লোক আছেন, তেমন ভাল লোক-ও আছেন প্রচুর। নমস্কার।

এই হল এ-যুগের তিন কন্যার কাহিনী। আর-ও বহু গল্প রয়েছে জানেন? যেমন এই সেদিন-ই শুনলাম এক অদ্ভুত ঘটনা।  আজকালকার দিন-এ এও সম্ভব। একটি দশ বছরের মেয়ে, তার মা, মাসি, এবং দিদা তাদের কুল-গুরুকে অনুরোধ করে তার সাথে মৈথুন করিয়েছে!মেয়েটা-কে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জোরে টিভি চালিয়ে দিয়েছে, মেয়েটা ভিতরে চিৎকার করছে। এই অন্ধকার কি কোনোদিন-ও কাটবে? মেয়েটা তার বন্ধু-এর মায়ের সাথে থানাতে গিয়ে এফ আই আর করে, তাদের গুরুবাবা তাকে গুড টাচ না করে ব্যাড টাচ করেছে, এই মর্মে। তাই আমরা জানতে পারি। এইসব অভিভাবক-দের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার।

এত গল্প থাকতে আমি এই তিনটে গল্পই বাছলাম কেননা নাম ছাড়াও এদের জীবনের একটা মিল রয়েছে। এদের তিনজনের প্রতিকুলতা তাদের ঘরের থেকেই এসেছে, তাই বুঝি এরা আজ এতো বন্ধু। এরা প্রত্যেকেই চরম নিষ্ঠুরতার শিকার, কিন্তু প্রত্যেকেই একটা সাকসেস স্টোরি। তারা এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর জন্যে তাদের সাফল্যের কাহিনী ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকের কাছে। তারা একটা গ্রুপ করেছে যেখানে এই ধরণের অভাগা মেয়েদের সোশ্যাল মোবিলিটি, এবং মেন্টাল সাপোর্ট দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা কমন জায়গা না হলে এটা হয়ত সত্যি-ই অসম্ভব হত।

তাই এ কথা মানতেই হবে যে বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আজ অনেক পাল্টেছে।  ভাবুন তো, অ্যাসিড এটাক-এর একজন ভিক্টিম-কে সমাজ আজ মিস ইউনিভার্স করছে! এ মনের প্রসারতা না হলে কি সম্ভব, মিস ইউনিভার্স-এর তথাকথিত বয়সের সীমা, রূপ-এর সংজ্ঞাই আজ কতটা পাল্টে গিয়েছে বলুন তো?

বহু মেয়েরা এগিয়ে এসে তাদের গল্প শেয়ার করছে। প্রত্যেকেই বলছে, ঘটনাগুলি যত না বেদনাদায়ক, তার থেকে আরও বেশি কষ্টের হচ্ছে সমাজের কটাক্ষ।  সমস্ত নারীরাই আজ একই ভাষায় কথা বলছে, যে তারা অত্যাচারের শিকার হওয়া সত্ত্বেও সমাজ তাদের কেন স্বীকার করে না? তাই আরো অনেক পথ চলা বাকি আছে। এক ভয়াবহ রিপোর্টে পড়লাম যে ৮০% ধর্ষণ বাড়ির ভিতরে হয়! এবার বুঝি বলবার সময় এসেছে, 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে', ঘরে ঘরে তাই সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। নয়ত অপরাধীরা ছাড়া পাবে, কেউ কেউ আবার সমাজ-এর রক্ষক-ও হয়ে বসবে।

নমস্কার।

 

Thursday, 6 May 2021

সন্দীপ মোটেও একা থাকে না

সন্দীপ বহু বছর পর পাটনা থেকে প্রথমে দাদা প্রদীপের বাড়িতে দীর্ঘ ন' মাস কাটিয়ে তার নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটে এলো, পাকাপাকি ভাবে থাকতে। আর অমনি শুরু হলো প্রশ্ন আর প্রশ্ন। 

আপনি একা থাকেন?

না।  

আর তো কাউকে দেখিনা।

আসলে আমার পরিবার পাটনাতে থাকে, মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করে।  

ও, তার মানে বেশির ভাগ সময় আপনি একাই থাকেন, তাই তো ?

তা বলতে পারেন।  

বৌকে ছেড়ে থাকেন কি করে মশাই? 

কষ্ট করে।  

হা হা হা ! ভাল বলেছেন।  বেশ রসিক মানুষ দেখছি।  

আচ্ছা, আজ আসি একটু তাড়া আছে।  

আরে যাচ্ছেন কোথায়? বলছি, রান্নাবান্না কে করেন? 

আমি সব নিজেই করি।  এই তো এখন বাজার করে ফিরে রান্না করে বেরুতে হবে আপিসে।  

বলছিলাম সন্ধ্যায় আসবো নাকি? একটু বসা যেত।  

আমি ওসব খাই না।  আচ্ছা, আসি।  

এই বলে সন্দীপ হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।  ও আসার পর থেকেই লোকজনের নানা প্রশ্ন।  পাড়া-পড়শি থেকে কাজের লোক, এমন কি মিস্তিরি, সবজিওয়ালা, ফেরিওয়ালা সবাই জানতে চায় সন্দীপ কেন একা থাকে।  আর ও সবাইকে বলে যে ও একা থাকে না।  লোকমুখে বলাবলি করতে শোনে অনেক কথা, 

'আরে দেখো গিয়ে হয়ত কোন কান্ড ঘটিয়েছে, বলে পরিবার আসে, কিন্তু আজকাল যা হচ্ছে, যে আসে সে যে পরিবার তার কি কোন প্রমান আছে?' ইত্যাদি প্রভৃতি। 

সেদিনই তো একজন ভদ্রলোক সন্দীপের কাছে জানতে চাইল ওর ঘরটা ফাঁকা পাওয়া যাবে কিনা।  বেশি না, দু ঘন্টার জন্য। 

একে একা থাকার জ্বালা, তার ওপরে এই সব উটকো ঝামেলা। সব কিছু তাকেই তো করতে হয়, কখন বাড়ি আসে কখন যায় তাতে কারুর কিছুই যায় আসেনা, খেতে বসে চোদ্দবার উঠতে হয়, গরম করো রে, খাবার বাড়ো রে, খাবার পর সাটোন আটন করো রে, বাসন মাজ রে, কত কী!  একদিন তো খেতে বসে দেখলো নুন-ই নেই, নুনের কৌটোতে নুন শেষ।  বাড়াভাত রেখে রবিবার ঠাঠা পড়া রোদ্দুরে বেরিয়ে নুন এনে তবে পাতে নুন নিয়ে খেল।  তবে সেদিন সন্দীপ কাঁদেনি।  ও কেঁদেছিল সেইদিন যেদিন ওর রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না, পেটে দাউ দাউ খিদে, অর্ডার আউট করল।  

মটন- কষা থালি, তিনশো ষাট প্লাস জিএসটি। খাবার এলো রাত সাড়ে দশটায়। খাবার খুলে দেখল মাংস, ডাল, তরকারি ঘেঁটে ঘ, একটা ডিম দেখতে পেল, হাত দিয়ে দেখে ওটা রসগোল্লা, ঝোল আর রসে মিশে একাকার।  সন্দীপের মনে হল ঠিক বিয়ে বাড়ির পর ভিখারিরা  যেমন আবর্জনা থেকে খায়, সেইরকম।  কান্নায় ভেঙে পড়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সেদিন সন্দ্বীপ।  

সাধারণ জিনিসই কীরকম অসাধারণ মনে হয় এখন তার, কলিং বেল বাজিয়ে ঘরে ঢোকার আনন্দ যে কি, সেটা সে ভুলেই গেছে আজ বহুদিন।  বাড়ির দরজার সামনে ছোটবেলায় আগে চটির ভিড় থাকত, সে সব এখন ইতিহাস।  

কাজের লোক রেখে আরেক অশান্তি, কাজের লোক ওকে বলে, 'দাদা, আমার ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, টাকার দরকার, দেবেন? আপনি যা বলবেন করবো। 

ওপরে থাকেন একজন মহিলা, তার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগত সন্দীপের, তার একটা ছোট্ট নাতি, ছুটির দিনগুলি তাদের সাথে বেশ কাটছিল সন্দীপের, একদিন রবিবার দুপুর বেলা উনি এলেন একা, এসে বলেন যে উনি ছত্রিশ বছরে বিধবা হন, তারপর সেলাই করে ছেলে মেয়েদের বড় করেন, নিজের শরীরের খিদে কিছুই মেটাতে পারেননি।  সন্দ্বীপ কিছু বোঝার আগেই সে দেখে ওই মহিলা সন্দীপের গায়ের ওপরে। কি করবে বুঝতে না পেরে ও ঐরকম ভাবেই পড়ে রইল, তারপর উঠে পড়ে ওনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওপরে পাঠান। বলাই বাহুল্য তারপর থেকে ওদের আসা বন্ধ হল।  

শুধু পাড়াপড়শিরা নয়, বন্ধুবান্ধব, কলিগ, আত্মীয়স্বজন সবাই ছেকে ধরে।  ওর এক পাড়ারই দাদা ওর বাড়ির চাবি রাখত, সে অনেক আগের কথা, তখন তো সন্দীপ সাফল্যের শিখরে, ভেবেছিল কলকাতার এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবে। তখন জানতো না, নিয়তি কি লিখে রেখেছে ওর জন্য। ও তাই ওর দাদাকে বলেছিল ওই ফ্ল্যাটটা, যেখানে ও এখন থাকে, সেটা বিক্রি করে দিতে। উনি স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করেন।  এখানে আসার পর সন্দীপ একদিন ওর বাড়ি গিয়ে দেখে একটা চকচকে কাঠের আলমারি, ও হাত বুলিয়ে বলে বৌদিকে: 

- এটা বেশ ভাল তো!' বৌদি তৎক্ষণাৎ বলে, 'আর বলোনা, তোমার দাদার এই পরোপকারের স্বভাব, এটা তো তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে, বুঝতেই পেরেছ নিশ্চয়?

- না বৌদি আমি বুঝতে পারিনি। তা এটা এখানে এলো কেন?

- ও তোমার দাদাকে জিজ্ঞেস করো, আমার ঘরে জায়গা জুড়ে আছে, ভালো লাগেনা।

- দাদাকে কেন জিজ্ঞেস করবো? এটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিতে বল, আচ্ছা, দাদা তো নেই বাড়িতে, আমিই ফোন করে বলব, তোমায় কিছু বলতে হবেনা।  

এসে সেদিন রাতেই ফোন করে সন্দীপ,

- রুপুদা!

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি শুনেছি, তোর যখন ইচ্ছে নিয়ে যাস।  

- আমি নিয়ে যাব? তুমি পাঠাবে না? 

ও বৌদির কথা শুনতে পায়, 'এই আলমারিটা এখন নিয়ে গেলে আমার খুব অসুবিধে হবে, ওকে বলেছ, সবাই কিন্তু জিজ্ঞেস করেছে ও কেন হঠাৎ এতদিন পর এখানে একা এসে আছে, আমি কিন্তু মুখ খুলিনি।' সন্দীপ তৎক্ষণাৎ বলে, 

- রুপুদা, আমিই নিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো। তোমায় কিছু করতে হবে না। 

তার পর দিনিই সন্দীপ ঠেলা ভাড়া করে আলমারিটা নিয়ে আসে।  কাউকে কোনোদিন কিছু বলেনি ও।  এই রূপুদার কাছে ও চিরকৃতজ্ঞ। কেননা উনিই সন্দীপকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাকরি দেন। আর এ কথাও সত্য যে উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বাড়িটা বিক্রি করার জন্য, এই একটা ঘটনা দিয়ে তাকে কখনই বিচার করা যায়না।  আর ভালোই তো হয়েছে বিক্রি হয়নি, নাহলে কোথায় থাকত আজ সে? পাটনা থেকে আসার পর সন্দীপের দাদা প্রদীপ ওকে ন মাস আশ্রয় দেয়।  তারপর আস্তে আস্তে নিজের ফ্ল্যাটে আসে সন্দীপ, নিজের জগৎ, যেখান থেকে ওকে কেউ কোনোদিন চলে যেতে বলবেনা।  

এইরকম নানান টুকরো টুকরো ঘটনার মোকাবিলা করতে করতে প্রায় দু বছর পর সন্দীপ একটু শক্ত- সামর্থ্য হয়েছে।  তার একা থাকার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।  আজ ও সবাইকে বলে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে।  হ্যাঁ, ও একা।  কে দোষী, কেন ডিভোর্স হয়েছে এ সব প্রশ্ন ওকে আজকাল কেউই করেনা।  জানে উত্তর পাবেনা।  

ওর বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট দালান আছে, সেখানে নানান রকম পশু, পাখি আসে, বুলবুলি, টুনটুনি, চড়াই, টিয়া, কাক, শালিক, কাঠবেড়ালি, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি প্রভৃতি, তাদের নিয়েই ওর সময় কাটে, কিছু গাছ আছে।  যখন ওদের জল দেয়, ওদের সাথে কথা বলে সন্দ্বীপ, পাখিদের খেতে দেয়, কখন বিস্কুট, কখন ভাত, ডাল, কখনো মাংস, ডিম্।  পাখিদের খাবার এটিকেট দেখে ও কত কিছু জানতে পারে, সবচাইতে আগে খায় কাক, তারপর আসে চড়াই, তারপর শালিক, আর সবশেষে আসে কাঠবিড়ালিরা।  

ওদের সাথেই কথা বলে, অনেকে ওকে জিজ্ঞেস করে, 'তা কার সাথে কথা বলেন আপনি?' সন্দীপ হেসেই উড়িয়ে দেয়।  তবে যখন ও প্রেসার কুকার, থালা, বাসন, গেলাসের  সাথে কথা বলে, তখন সত্যিই মনে হয় বাড়িতে কেউ আছে! 

'তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নেই? বলছি আসছি, এরই মধ্যে তিনটে হুইসিল দিতে হলো? এখন দেখতো, গলা ভাত খেতে হবে আমাকে!' মাইক্রোওয়েভ থেকে গরম খাবার বার করতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 'ওরেব্বাবা! এতো গরম? তোর মাথায় কোন বুদ্ধি নেই? বলি থামতে জানিস না? ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে ! এতো গরম কেউ খেতে পারে?' ওয়াটার পিউরিফায়ার থেকে যখন জল গড়িয়ে পরে, ও ঘর ঝাঁট দিতে দিতে চিৎকার করে বলে, 'পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে, দেখো! দেখছিস ভরে গেছে, তবুও পড়েই যাচ্ছিস, অন্ধ নাকি?' গমগম করে টিভি চালিয়ে রাখে সন্দ্বীপ, ওর মনে হয় বাড়িতে ভর্তি লোক।  

ওর প্রতিবেশীরা খুবই ভাল লোক।  সবাই এক প্রকার মেনেই নিয়েছে যে সন্দীপ মোটেও একা থাকে না।